ছাত্র রাজনীতির নতুন দিগন্ত: নিষিদ্ধ নয়, সংস্কার হোক
আপলোড সময় :
০৯-০১-২০২৫ ১২:৫৮:১৬ পূর্বাহ্ন
সাঈদ মুহাম্মাদ সানোয়ার
জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান হেলাল হাফিজের সেই কবিতা আবারো আমাদের স্মরণ করিয়ে দিলো- ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’। তরুণ-যুবকদের হাত ধরেই বারবার এই বাংলায় মুক্তির মিছিল হয়েছে, স্বাধীনতার পতাকা উড়েছে। এক অদম্য দূর্বার শক্তি নিহিত রয়েছে এই যুবকদের মধ্যে। যুগের পরিবর্তনে সেই শক্তি দখল করে নিয়েছে কিছু স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক দল। ক্ষমতায় টিকে থাকার সিঁড়ি বানিয়েছে তরুণ শিক্ষার্থীদের।
ছাত্র রাজনীতি বললেই এখন যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে আবরার ফাহাদের নিথর-রক্তাক্ত দেহটা! চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা, ভর্তি বানিজ্য, হলের সিট দখল, ইভটিজিং, ধর্ষণ, গ্রুপিং, দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ এখন ছাত্রনেতাদের পরিচয়। শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ এমনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগেও সরকার দলীয় ছাত্রনেতাদের সুপারিশ প্রয়োজন হয়। বর্তমান এই চিত্র ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে ম্লান করে দিয়েছে। ফলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, ক্যাম্পাস গুলোতে রাজনীতি বন্ধের কিঞ্চিৎ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। গবেষকদের মধ্যেও কেউ কেউ ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বলছেন। আবার অনেকে বলছেন, ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ নয়, বরং সংস্কার প্রয়োজন। তাঁদের মতে ছাত্র নেতাদের মধ্যে দেশপ্রেম ও মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে।
তাদেরকে বোঝাতে হবে ছাত্র রাজনীতি মানে সরকার দলের লেজুড়বৃত্তি করা নয়, দলীয় ছায়াতলে থেকে চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি-দখলদারিত্বের মাধ্যমে আঙ্গুল ফুলিয়ে কলাগাছ হওয়া নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বল প্রয়োগ করে অর্থ আত্মসাৎ করা নয়, বয়স পার হয়ে যাওয়ার পরেও আদুভাই হয়ে আবাসিক হলগুলোতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ক্ষমতার রাজনীতি চর্চা নয়। ছাত্রনেতাদের মনে রাখতে হবে, তারাই আগামী দিনে জাতির কর্ণধার। সুতরাং তাদের শুধু নেতা নয়, হতে হবে একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্ব। তারা যেমন তাদের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করবে, ক্ষমতাকে জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে, তেমনি তাদের কর্তব্যের বিষয়েও সচেতন থাকবে। তারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে চিন্তা করবে, ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের বাকস্বাধীনতা রক্ষায় কাজ করবে।
বিভিন্ন দিকে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের যে গুঞ্জন উঠেছে- এটা একদিকে যেমন একজন শিক্ষার্থীর রাজনৈতিক অধিকার হরণ করবে আবার অন্যদিকে ছাত্র রাজনীতি সংস্কার না করে নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে আমরা এমন একটি রাজনীতি বিমুখ প্রজন্ম তৈরি করে ফেলবো, যারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসিন ও অনভিজ্ঞ হবে। আমরা যে সোনার বাংলাদেশের স্বপ্ন লালন করি, সেই সোনার বাংলাদেশ গড়ার জন্য প্রয়োজন একদল তেজোদীপ্ত তারুণ্যের নেতৃত্ব। সেই তরুণ নেতৃত্বের হাত ধরেই পরিবারতন্ত্রের কালো ছায়া থেকে বেরিয়ে আসবে বাংলাদেশের রাজনীতি। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হলে রাজনীতি সচেতন এমন তরুণ নেতৃত্ব থেকে জাতি বঞ্চিত হবে। এই সুযোগে হয়তো জন্ম নিবে নব্য ফ্যাসিবাদ।
দেশ ও জাতির সর্বাত্মক স্বার্থে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ না করে সংস্কারের দিকে নজর দেয়া হবে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। নেতৃত্বে গতিশীলতা সৃষ্টির মাধ্যমে ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির সংস্কার শুরু করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতি বন্ধ করে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমের নেতৃত্বে গতিশীলতা সৃষ্টি করতে হবে। অথবা দলীয় রাজনীতি চালু রেখেও ছাত্র সংসদ নির্বাচন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দলীয় রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন সমূহকে ক্যাম্পাসে রাজনীতি চর্চার জন্য নির্ধারিত নিয়ম-নীতির আওতায় আনতে হবে।
শুধু বাংলাদেশেই নয়, বহির্বিশ্বেও ছাত্র রাজনীতির গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। ১৮৪৮ সালে জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার বিপ্লবের মূলশক্তি ছিল ছাত্র সমাজ, রাশিয়ার ‘জারতন্ত্রের’ আমলে ছাত্ররাই বিভিন্ন বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনা ঘটায়, ১৯৫৫ সালে আর্জেন্টিনায়, ১৯৫৮ সালে ভেনিজুয়েলায়, ১৯৬০ সালে কোরিয়ায় এবং ১৯৬৪ সালে ভিয়েতনাম ও বলিভিয়ার জাতীয় সংকটে ছাত্র সমাজ দেশ গঠনের আন্দোলনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে।
এদেশেও ছাত্র সমাজ স্বাধীনতার পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে দেশের ক্রান্তি লগ্নে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এক হয়ে লড়েছে দেশের জন্য। সর্বশেষ জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান তার জীবন্ত উদাহরণ। ১৫ বছরের একচ্ছত্র স্বৈরাচারী শাসককে গুনে গুনে ৩৬ দিনে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে তারা। কিন্তু সেই তারুণ্যের শক্তিকে ইতঃপূর্বে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখা যায়নি। এবারও সেই শক্তিকে ভিন্ন দিকে ব্যবহার করার পাঁয়তারা চালানো হচ্ছে।
বিভিন্ন দেশে রাজনীতির প্রেক্ষাপট ভিন্ন ভিন্ন হলেও ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা সব দেশে একই। আর তা হলো জাতীয় নেতৃত্বের পাইপ লাইন তৈরি করা। আজকের ছাত্ররাই আগামী দিনে জাতির ভবিষ্যৎ। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে সংস্কার আমরা প্রত্যাশা করছি, তার শুরুটা হতে হবে ছাত্র রাজনীতি থেকেই। এর মাধ্যমেই একদল যোগ্য, দক্ষ, দায়িত্বশীল, দেশপ্রেমিক নেতা তৈরি হবে- যাদের নেতৃত্বেই বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।
কমেন্ট বক্স